অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব কী এমন গোপন কথা জানেন যে, তাঁর জন্য স্বর্গ–মর্ত্য ছুটে বেড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী (বিধায়ক নন), তোপ শুভেন্দুর
বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
সহজে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিবকে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে শো–কজ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা তিনদিনের মধ্যে জানতে চাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই শো–কজের জবাব আলাপনবাবু দেবেন বলে নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে। এর মধ্যে রাজ্যপাল অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মমতা যোগ দেবেন না বলে তাঁকে নাকি আগের দিনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে এদিন মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রাক্তন মুখ্যসচিবকে তীব্র আক্রমণ করেছেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও।
মঙ্গলবার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পাঠানো চিঠিতে তাঁকে বাংলার মুখ্যসচিব হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে চিঠিতে পরিষ্কার ভাষায় এবং সোজাসুজি লেখা হয়েছে, কলাইকুণ্ডায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তথা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের প্রধান নরেন্দ্র মোদির পর্যবেক্ষণ বৈঠকে উপস্থিত না থেকে ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ (বি) ধারা লঙ্ঘন করেছেন আলাপনবাবু। তাই কেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সেই ব্যাখ্যা আলাপনবাবুর কাছে জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। বৃহস্পতিবারের মধ্যে সেই উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আকাশপথে পরিদর্শনের পর কলাইকুণ্ডার বায়ুসেনাঘাঁটিতে পৌঁছেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠকের বিষয়টি আগে থেকেই ঠিক ছিল। কিন্তু কলাইকুণ্ডায় পৌঁছনোর পর রাজ্যের প্রতিনিধিদের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ১৫ মিনিটের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের এক আধিকারিক তখন বাংলার মুখ্যসচিবের কাছে জানতে চান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধিরা বৈঠকে যোগ দেবেন কিনা! আশ্চর্যের বিষয় হল, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেখানে আসেন মুখ্যসচিব। তাঁর সঙ্গে বাংলার দাবিপত্র দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে চলেও যান। বিষয়টি যে কেন্দ্রীয় সরকার হালকা ভাবে নিচ্ছে না, তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে।
সেদিনের ওই ঘটনার পরই দিল্লি থেকে তলব করা হয় ‘মুখ্যসচিব’ আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শুধু তাই নয়, ৩১ মে দিল্লিতে এসে ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীবর্গ মন্ত্রকে যোগ দিতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা চিঠি লিখে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ওই নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়নি। অন্যদিকে, রাজ্য সরকারও আলাপনকে ছাড়েনি। রাজ্য সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে সোমবার দিল্লি যাননি আলাপন। পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকার যাতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে না পারে, সেইজন্য ওই দিনই তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নেন। বিষয়টির নেপথ্যে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনাচিন্তা কী, তা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অস্পষ্ট থাকেনি। আলাপন অবসর নেওয়ার পরই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী নিজের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। তিন বছরের জন্য আলাপন ওই পদে থাকবেন। নবান্নেই হবে তাঁর দফতর। শুধু তাই নয়, মুখ্য উপদেষ্টা ছাড়াও আলাপনকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এটিআই)–এর ডিরেক্টর পদেও নিয়োগ করেছে রাজ্য সরকার।
নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, আলাপনবাবু শো–কজের জবাব দেবেন। তবে সেই জবাব তিনি স্বাভাবিক কারণেই এখন আর মুখ্যসচিব হিসেবে দিতে পারবেন না, দেবেন মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে। মঙ্গলবারই তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও রাজ্যের প্রাক্তন আমলারা এ বিষয়ে রাজ্য সরকার এবং আলাপনবাবুর পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, কর্মজীবনের শেষদিনে অবসর নিয়ে আলাপনবাবু কেন্দ্রীয় সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি অনেক কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিকই। তাঁদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে আলাপনবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তাঁকে শো–কজ নোটিশ পাঠানো হয়েছে। জবাব কেন্দ্রীয় সরকারকে সন্তুষ্ট না করলে নির্দেশ অমান্য করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত এবং কড়া ব্যবস্থা নেওয়ারও ভাবনাচিন্তা করছে কেন্দ্রের কর্মীবর্গ ও প্রশিক্ষণ মন্ত্রক।
এর মধ্যে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের একটি টুইট ঘিরে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এই বিতর্ক আরও জটিল হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, ইয়াস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক বয়কটের পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘২৭ মে রাত ১১.১৬ মিনিটে মমতা মেসেজ করে লিখেছিলেন, কথা বলতে পারি? খুব জরুরি।’ এর পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয় রাজ্যপালের। তখনই মমতা নাকি তাঁকে ইঙ্গিত দেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি যোগ দেবেন না। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের প্রতিক্রিয়ায় দুই ধরনের বক্তব্য উঠে এসেছে। এক পক্ষ জানিয়েছে, ব্যক্তিগত মেসেজের কথা প্রকাশ্যে এনে ঠিক করেননি রাজ্যপাল। অন্য পক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, এমন কোনও মেসেজ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালকে করেননি। অসত্য বলছেন তিনি। রাজ্যপালের কথা থেকে পরিষ্কার, মুখ্যমন্ত্রী যদি বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা ভেবে না থাকেন, তা হলে কেন্দ্রের আইএএস হয়েও তাঁর ভাবনার শরিক হয়েছেন আলাপন।
এদিকে, এদিন বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। একেবারে নজিরবিহীন ভাবে এদিন তিনি টুইট করে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনার পাশাপাশি রীতিমতো আক্রমণ শানান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও। মুখ্যমন্ত্রীর কথা লিখতে গিয়ে তাঁকে ব্যাকেটে ‘বিধায়ক নন’ বলেও উল্লেখ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করে শুভেন্দু টুইটে লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে অলীক কুনাট্য রঙ্গ চলছে। নিজের অহংবোধ এবং অনুশাসনহীন মুখ্যসচিবকে রক্ষা করতে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভাঙতে উদ্যত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী (বিধায়ক নন)। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দফতর এবং সংবিধানের অসম্মান করছেন। অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব কী এমন গোপন কথা জানেন যে, তাঁর জন্য স্বর্গ–মর্ত্য ছুটে বেড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী (বিধায়ক নন)।’
পাশাপাশি ‘বিধিভঙ্গের’ জন্য আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা নিয়োগ করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শুভেন্দু। তিনি লিখেছেন, ‘করদাতাদের পয়সা লুঠ করা তৃণমূলের নেশা। অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী (বিধায়ক নন)–র উপদেষ্টা এবং তিনি আড়াই লক্ষ টাকা মাসিক বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা ভোগ করবেন। করদাতাদের কষ্টার্জিত পয়সা নিশ্চিত ভাবেই এর থেকে অনেক ভালো ভাবে খরচ করা যেত।’